আমি আর হাসান বসে গল্প করছি। হঠাৎ আমি দেখলাম মেডিকেল কলেজ ও ব্যারাকের মাঝখানটাতে পিঁপড়ে যেমন শস্যদানাকে ঘিরে নিয়ে আসে, সে রকম পাঁচ-ছয়জনের একটা জটলার মতো, তারা কি যেন নিয়ে আসছে। আমার কৌতূহল হলো, আমি দৌড়ে ওখানে গেলাম। আমিও ওই দলে ঢুকে গেলাম। দেখলাম প্যান্টের মধ্যে শার্ট গোঁজা, লম্বা শেভ করা একজনকে। তার সারা মুখে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঘামের বিন্দু। আর কল খুলে দিলে যেমন অঝোরে পানি পড়ে তেমনি রক্ত ঝরছে। সে বারবার জীভ বের করছে আর বলছে- পানি পানি। আমার হাতের রুমালটা ঘামে পানিতে ভেজানো ছিল। আমি ইতস্তত করছিলাম রুমালটা নিংড়ে দেব কিনা। সে কাটা মুরগির মতো ছটফট করছিল। অবশেষে আমি নিংড়ে দিলাম। সে ফিসফিস করে বলল, ‘আমার নাম আবুল বরকত, বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন, পল্টন লাইন, আমার বাড়িতে খবর দিয়েন।’ আর কিছু বলেনি। বডিটাকে আমরা যখন মেডিকেলে নিয়ে গেলাম সেখানে টিয়ার গ্যাস ও লাঠির্চাজে আহত আরো অনেকে এসেছে। প্রথম গুলিবিদ্ধ কাউকে আমরাই নিয়ে গিয়েছিলাম।
‘৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাহিত্য সম্মেলন হলো, এখন যেটা বাংলা একাডেমি সেটা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বাসভবন। ওই পরিত্যক্ত ভবনে সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হলো। তার দায়িত্বে ছিলাম আমি, রশিদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, কাইয়ুম চৌধুরী ও দেবদাস চক্রবর্তী। আমিনুল ইসলাম তখন ইতালিতে। আমার একটি কাজ ছিল ওই প্রদর্শনীতে। নাম ‘রক্তাক্ত একুশে’।
শুধু ওই একটি দিনকে কেন্দ্র করেই আমাদের মধ্যে কিছুদিনের জন্য পুনরুজ্জীবিত হয় বাঙালি চেতনা। তারপর মাস পেরোতেই আকাশ-সংস্কৃতির আগ্রাসনে অপসংস্কৃতির জোয়ারে সেই চেতনার হয় বিসর্জন। আজকে যদি চার শহীদের নামে রাস্তা থাকত, যে বালক বা শিশু সবে পড়তে শিখেছে, সে বানান করে পড়ত এবং বাড়িতে জিজ্ঞেস করত- রফিক কে? বরকত কে? এগুলো হয়নি। আর হয়নি বলে আমরা একুশের চেতনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। একুশের চেতনা মানে শুধু মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন নয়, একুশের চেতনা মানে এ দেশের আপামর জনসাধারণের সার্বিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তি।
আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি, একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির জন্য একটা গৌরবের অধ্যায়, আমার জন্য তো বটেই। কারণ, আমি সেই আন্দোলনে শরিক হতে পেরেছি।
একুশের চেতনা
-মুর্তজা বশীর
শিল্পপ্রভা
অষ্টম বর্ষ: প্রথম সংখ্যা। পৌষ-ফাল্গুন ১৪২৬
Volume VIII Issue 1: January-march 2020