ঠাকুরগাঁও জেলার ঐতিহাসিক স্থাপনা বালিয়া মসজিদ (Balia Mosque)

লেখক: চৌধুরী মোঃ সিফাত বিন সারোয়ার (নির্ণয় চৌধুরী)

ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে বালিয়া মসজিদ (Balia Mosque) অন্যতম।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ১৫ কি.মি. উত্তর পূর্ব দিকে বালিয়া ইউনিয়নে এক অনিন্দ্য সুন্দর ঐতিহাসিক মসজিদ অবস্থিত। কিন্তু শতবছর ধরে এই মসজিদ লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলো।এর সম্পর্ক জানতে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে ১৮ শতকে। সেসময় বালিয়া এলাকায় এক বিখ্যাত প্রজাদরদী জমিদার ছিলেন, নাম মেহের বকস্ সরকার। তার সম্পর্কে অনেক গল্প এখনো বালিয়া এলাকার লোকমুখে প্রচলিত আছে।মেহের বকস্ সরকারের স্ত্রী গুলমতি নেছা ব্রিটিশ দের কাছে সুষ্ঠভাবে নিজের জমিদারী কর/ট্যাক্স পৌছানোর স্বীকৃতি স্বরুপ চৌধুরানী উপাধী লাভ করেন।মেহের বকস্ সরকারও সে সূত্রে চৌধুরী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।যাই হোক সে অন্য ইতিহাস। মেহের বকস্ চৌধুরী ১৮ শতকের শেষভাগে বালিয়াতে এক মসজিদ তৈরীর পরিকল্পনা করেন। সেলক্ষ্যে দিল্লি থেকে মিস্ত্রি আনা হয়। এই মসজিদ তৈরি ছিল অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ইট তৈরী,চুন সুড়কির কাজ সব মিলিয়ে এক কঠিন কর্মযজ্ঞ। সেসময় এতো ইটের ভাটাও ছিলো না। তাই ব্যক্তিগত উদ্যেগে ইট তৈরীর ব্যবস্থা করা হয়,সেটাও ছিলো জটিল প্রক্রিয়া। তবু পুরোদমে কাজ চলছিল। মসজিদের ছাদ পর্যন্ত নির্মাণ হয়,কিন্তু গম্বুজ নির্মিত হয়নি।এই সময় হঠাৎ হেডমিস্ত্রির মৃত্যু হয়,এবং মসজিদ তৈরী থেমে যায়,পরবর্তীকালে মেহের বকস্ চৌধুরী স্থানীয় মিস্ত্রীদের দ্বারা কাজ শুরু করালেও তারা গম্বুজ নির্মাণ করতে ব্যর্থ হয়।মসজিদ তৈরী শতবছরের বেশি সময়ের জন্য বন্ধহয়ে যায়। মেহের বকস্ চৌধুরীও ১৯০৫ সালে ইন্তেকাল করেন।তার মৃত্যুর পর তার পরিবারের সদস্যরাও চেষ্টা করেছিলেন মসজিদ নির্মাণ সমাপ্ত করতে। কিন্তু তারাও ব্যর্থ হয়ে যান। অবশেষে মসজিদের নির্মাণ কাজ শতবছরের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এবং স্থাপনা এলাকা জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে ও সাপ, পোকামাকড়ের বাসস্থানে পরিণত হয়।

এরপর ৮০ এর দশকের কথা। তখন মেহের বকস্ চৌধুরীর সুযোগ্য পৌত্র (নাতি) জননেতা রেজওয়ানুল হক ইদু চৌধুরী তখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এবং ঠাকুরগাঁও -০১ আসনের সংসদ সদস্য। তিনি ঢাকা থেকে একজন প্রকৌশলীকে এনে এই মসজিদ সংস্কার করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।কিন্তু সেই প্রকৌশলী মত প্রকাশ করেন এই মসজিদ কোনভাবেই আর সংস্কার করা সম্ভব না,তখন ইদু চৌধুরী নিজস্ব উদ্যোগে সোনাপাতিলা মসজিদ নির্মাণ করেন।

এরপর ২১ শতকে ছোট বালিয়া এলাকায় মসজিদের প্রয়োজন দেখা দিলে নতুন মসজিদ নির্মাণ এর পরিকল্পনা করা হয়।এ নিয়ে বহু তর্কবিতর্কর পর অবশেষে সেই পরিত্যক্ত মসজিদ সংস্কার এর জন্য সিদ্ধান্ত হয়। বালিয়া চৌধুরী বংশের পরবর্তী প্রজন্ম মসজিদ সংস্কার এর এই উদ্যেগ গ্রহণ করে। এবারে মসজিদ সংস্কারের প্রথম উদ্যোগ যারা নিয়েছিল তাদের অন্যতম হল বালিয়া চৌধুরী পরিবারের সন্তানেরা যেমন শিল্পী কামরুজ্জামান স্বাধীন, শাহীদ জাকিরুল হক চৌধুরী, মরহুম আলহাজ সাইফুল আলম নুরুজ্জামান চৌধুরী,আনসারুল হক চৌধুরী এবং মসজিদ সংলগ্ন বাড়ির দু এক জন। মসজিদ সংস্কারে প্রথম তিনজন সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে, এরমধ্যে তৃতীয় জন সংস্কারের শুরু থেকে উনার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মসজিদের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উনি মৃত্যুসজ্জায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও মসজিদের খবরাখবর নিতেন। উনার চিন্তা ভাবনাই ছিল মসজিদ কেন্দ্রিক । মসজিদ সংস্কারের যত ফান্ড সবই উনি নিজ উদ্যোগে প্রথম দুজনকে সংগে নিয়ে যোগাড় করেছেন। উনার অনুরোধেই বালিয়া চৌধুরী পরিবারের মেয়ের ঘরের সন্তান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর শিক্ষক আর্কিটেক্ট সৈয়দ আবু সুফিয়ান কুশল গম্বুজ এর ডিজাইন, সংস্কারের পর মসজিদটি দেখতে কেমন হবে সেই ডিজাইন এবং অজুখানার ডিজাইন (যা এখনও হয়নাই) তৈরী করেন ।

এই বৃহত্তম কাজে প্রধান পৃষ্ঠপোষক এর ভূমিকা পালন করেন মেহের বকস্ চৌধুরীর সুযোগ্য প্রোপৌত্রি তসরিফা খাতুন। তসরিফা খাতুন নর্দান তসরিফা গ্রূপের চেয়ারম্যান এবং সেইসাথে সফিউদ্দিন আহমেদ ফাউন্ডেশন ও চক্ষু হাসপাতাল এর ও চেয়ারম্যান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একদল শিক্ষার্থী সেই মসজিদ পরিদর্শন করে সংস্কার করার ইতিবাচক মনোভাব দেখায়। সেই শিক্ষার্থীরা নিজেরাই এবং কিছু শ্রমিক মসজিদের জঙ্গল পরিস্কার করেন।

এরপর শুরু হয়ে যায় ঐতিহ্যকে অবিকৃত রেখে পুননির্মাণ কাজ। আমাদের দেশে ঐতিহ্যবাহী ভবনসংরক্ষণের জন্য যেসব পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কোথাও কোথাও সংরক্ষণের নামে বিকৃতি ঘটানোরও অভিযোগ আছে। সোনারগাঁর পানামসিটি, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ এবং পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার সংরক্ষণের প্রক্রিয়া নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। আর এসব দিক থেকেই অনন্য উদাহরণ হয় এইবালিয়া মসজিদটির সংস্কারকাজ। যদিও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই কাজ তদারকিতে প্রথমে তেমন সদিচ্ছা দেখায়নি। অবশেষে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের লোকদের এই মসজিদ পুননির্মাণ এর কাজে তদারকির জন্য আনা হয়। এত দিন পর সংরক্ষণের প্রয়োজনে দেয়ালের কিছু অংশ খুলে ফেলা হয় । সেখানে দেখা যায়, বর্তমান দেয়ালের ১১ ইঞ্চি ভেতরে একই নকশার একটি দেয়াল। এই ভেতরের দেয়ালটির ইট ও মর্টারের সঙ্গে পরে নির্মিত ইট ও মর্টারের পার্থক্য রয়েছে। বিভিন্ন তথ্য মিলিয়ে মসজিদটির সম্ভাব্য বয়স নির্ধারণ করা হয় ১২০ বছরের অধিক। উল্লেখ্য, ব্যয়বহুল বলে বয়স নির্ধারণে কার্বন-১৪ বা থার্মালুমেনিসেন্স ধরনের কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা হয়নি। মসজিদটির আয়তন পূর্ব-পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি এবংউত্তর-দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি। আয়তাকার এই কমপ্লেক্সটিকে ‘সিঁড়িসহ প্রবেশপথ’, ‘খোলা চত্বর’ ও ‘মূল ভবন বা নামাজঘর’ এই তিনটি অংশে বিভক্ত করা যায়। মূলভবনটি পূর্ব-পশ্চিমে ২৫ ফুট ১১ ইঞ্চি প্রশস্ত। প্রবেশপথ, খোলা চত্বর ও মূল ভবন একই প্লাটফর্মের ওপর অবস্থিত। স্থানভেদে সাড়ে ৩ ফুট থেকে সাড়ে ৪ ফুট গভীর ভিত্তির ওপর ৫ ফুট সাড়ে ৩ ইঞ্চি উঁচু প্লাটফর্মের ওপর মসজিদটি স্থাপিত। প্লাটফর্ম থেকে ছাদের উচ্চতা ১৭ ফুট। ভিত্তিসহ পুরো মসজিদটিই চুন-সুরকির মর্টার এবংহাতে

পোড়ানো ইট দিয়ে নির্মিত।সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার শুরুতেই স্থাপনাটির ‘বিশদনথিভুক্তকরণ’ (ডকুমেনটেশন) করা হয়েছে। মানে,প্রতিটি অংশের আলোকচিত্র নেওয়া হয়েছে এবং দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক ছবি আঁকা হয়েছে। ছোট ছোট অংশের নির্মাণ-উপকরণ ও শৈলী চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে পরীক্ষা করা হয়েছে যে স্থাপনাটির কোন অংশ কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত। এবং তা নিরাময়ের জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি কী হতে পারে। গাছ, শৈবাল, ছত্রাক, ধুলোয় ঢাকা ভবনটির বিভিন্ন অংশের যথাযথ নথিভুক্তির জন্য আংশিকভাবে ‘শুষ্কপরিষ্করণ’ (ড্রাই ক্লিনিং) করাহয়।যেকোনো ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণের জন্যনৈতিকতাহলো, প্রতিটি পর্যায়ের প্রতিটি খুঁটিনাটি কাজেরবিবরণরেকর্ড করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, পদ্ধতিটি হতেহবে এমন যে ভবিষ্যতে যদি সংরক্ষণের কোনোআধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়, অথবা ভবিষ্যতেরসংরক্ষক যদিমনে করেন, আগের সংরক্ষক সঠিক পদ্ধতি ব্যবহারকরেননি, তাহলে তিনি যাতে স্থাপনাটি আগেরঅবস্থায় ফিরেপেতে পারেন।সংরক্ষণের দ্বিতীয় পর্যায়ে ভবনটিতে সৃষ্ট ফাটল ওগর্তগুলো পূর্ণ করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ফ্লুরোসিলিকেট-জাতীয় অজৈব লবণএটি ভবনটিকে ভেতরথেকে দৃঢ়তা দেয়। উল্লেখ্য, এই পদ্ধতি প্রয়োগেরআগে দেয়াল ও ভিত্তিতে ঢুকে যাওয়া শিকড়সরানোরজন্য সালফিউরিক এসিড ইনজেকশন দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে ভবনের দেয়ালে জমে থাকা ধুলো, শ্যাওলা,ছত্রাক, লবণ অপসারণের জন্য যথাক্রমে সাধারণপানি, ফুটন্তপানি, হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও পেন্টা ক্লোরোফেনল ব্যবহার করা হয়।সংরক্ষণের তৃতীয় ধাপে ভবনটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ারআগেরপর্যায়ে যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থায় ফিরিয়েআনারপ্রক্রিয়া করা হয় । অর্থাৎ যেসব দেয়াল ভেঙে খুলেপড়ে গিয়েছে, তা নতুন করে স্থাপন করা হয়। প্রথমতৈরির সময় যে আকৃতির ইট ব্যবহৃত হয়েছে, ঠিক একইধরনের নতুন ইট ব্যবহার করা হয়েছে।তবে মসজিদটির গম্বুজ নির্মাণের ক্ষেত্রে আগেরশৈলী আর ব্যবহার করা যায়নি। কারণ মসজিদটিরগম্বুজ কখনোতৈরিই হয়নি। ফলে গম্বুজগুলো কেমন হতে পারত, তাএখনআর বলা সম্ভব নয়।অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে ফল্স আর্চ পদ্ধতিতেইহয়তো গম্বুজগুলো তৈরির পরিকল্পনা ছিল। কিন্তুভবনটিতেযেহেতু কোনো সাপোর্টিং পিলার বা বিম নেই,তাইগম্বুজের ভার দেয়ালগুলো এখন আর দীর্ঘ মেয়াদেবহন করতে পারবে না।এ জন্যই গবেষকেরা মসজিদটির তিনটি গম্বুজ আধুনিকপ্রযুক্তিতে তৈরি করার পরিকল্পনা করেন।এবং সেই লক্ষে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মসজিদের আধুনিক মডেলের গম্বুজ তৈরী করা হয়। বর্তমানে মিনার তৈরী র কিছু কাজ বাকি আছে।সেটাও অতি সত্বর তৈরী করা হবে।অবশেষে দীর্ঘ সাধনার পরে ২০১০ সালে “ছোট বালিয়া মসজিদ” এর উদ্বোধন করা হয়।এই সময় বালিয়া চৌধুরী পরিবারের সকল সদস্যদের নিয়ে পুনর্মিলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

আধুনিক স্থাপনাশৈলীর সঙ্গে ঐতিহ্যবাহীস্থাপনাশৈলীরপার্থক্য বোঝানোর জন্য আজকাল বিশ্বব্যাপী সংযোজিত অংশটুকু সমসাময়িক প্রযুক্তিতে তৈরি করা হয়।মসজিদটির প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য এবংখোলাইটের স্থায়িত্ব বৃদ্ধির জন্য বর্ণহীন ফ্লুরোসিলিকেটজাতীয় প্রলেপ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু ভবন নিয়ে কাজই হবে না। গবেষকেরা মসজিদ চত্বরটিও বৈজ্ঞানিকভাবে সাজাতে চান। চত্বরে যেইউক্যালিপটাস লাগানো আছে, তা ভবনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।কারণ এই গাছ প্রচুর পরিমাণ পানি শোষণ করে। এ ধরনের গাছ ভিত্ত ও দেয়ালের আর্দ্রতা শোষণ করে ভবনের দৃঢ়তা নষ্টকরে দেয়। তাই ভবনের চারদিকে ইউক্যালিপটাস কেটে সেখানে চন্দন ও শাল গাছ লাগানোর প্রক্রিয়া চলমান।এই হলো ছোট বালিয়া মসজিদের বর্তমান পরিস্থিতি। বালিয়া চৌধুরী পরিবারের সদস্য বৃন্দ সহ এলাকাবাসীর সহযোগীতায় এ মসজিদ এখন ঠাকুরগাঁও এর এক অনন্য স্থাপনা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। প্রতিদিন দূরদুরান্ত থেকে বহু মানুষ নামায আদায় করা ছাড়াও এই মসজিদ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আসে।

২০০১ সালে বালিয়া মসজিদটির সংস্কার কাজ শুরু হয়। পরবর্তীতে ২০১০ সালে মসজিদটি মুসল্লিদের নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে খুলে দেয়া হয় ।

সহযোগীতায়:

০১/ জনাব শাহিদ চৌধুরী
০২/ জনাব সাইফুর রহমান
০৩/ জনাব রতন চৌধুরী

Image & text courtesy: Kamruzzaman Shadhin

Explore

Up Next

Discover

Other Articles