আমাদের কালের এক বড় মাপের চিত্রকর সফিউদ্দীন আহমেদ।বাঙালি মুসলিম সমাজের চিত্রকলার পাঠ গ্রহণের প্রথিকৃৎদের তিনি একজন এবং উপমহাদেশের অগ্রণী শিল্পশিক্ষালয় কলকাতা আর্ট স্কুলে কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষা সমাপন করে সেখানে যোগদান শিক্ষকতায়।দেশভাগের পর ঢাকায় এসে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলে নতুন শিল্পশিক্ষালয়।তারপর থেকে বিরামহীনভাবে তিনি কাজ করে চলেছেন নবীন শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিল্পের বোধ প্রেরণা ও দক্ষতা সঞ্চার করতে। সেই সঙ্গে চলেছে তার আত্মমগ্ন নিভৃত শিল্প সাধনা। দেশভাগের আগেই বাংলার সর্বভারতীয় বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন তরুণ শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ। পরবর্তীকালে আরো বহু সম্মান ও সম্মাননা অলংকৃত হয়েছেন তিনি। একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবেও তিনি তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি লাভ করেছে।বাইরের কোলাহলমুখর জীবনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে অন্তর্মুখী গভীর বোধসম্পন্ন এই শিল্পী শিল্প শিক্ষাদান ও শিল্পচর্চার তদ্গত সাধনায় সম্পূর্ণ মগ্ন হয়ে রয়েছেন বরাবর। ১৯৪৬ সালে সাঁওতাল জীবনভিত্তিক “দুমকা” পর্বের কাজ দিয়ে তিনি চমকে দিয়েছিলেন শিল্প রসিক ও সমালোচকদের। পঞ্চাশের দশকে “বন্যার কবলে” পর্যায়ের চিত্রমালা, কিংবা আরো পরে জাল, ক্রুদ্ধ মৎস্য, একাত্তরের স্মৃতি এইসব চিত্রসম্ভার তিনি ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করে চলেছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করার পাশাপাশি তাম্রতক্ষণে তিনি দেখিয়েছেন পরম কুশলতা।
তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন চারপাশের জীবনকে। জীবন থেকে শুষে নিচ্ছিলেন অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে ১৯৫৬ সনের ভয়াবহ বন্যার দুঃসহ অভিজ্ঞতা। তখন তিনি বন্যার কারণে জল বন্দি হয়ে ঘরের মধ্যে আটকা। খাটের উপর বসে দেখেছেন বন্যার জল আসছে আর যাচ্ছে। বাংলার জীবনের কঠিন বাস্তবতা তার স্মৃতিতে গাঁথা হয়ে থাকে। মাথার উপর অন্ধকারে উদার আকাশ। অন্যমনস্ক চেয়ে চেয়ে আছেন খাটের নিচে ফুঁসে ওঠা জলের ঘূর্ণির দিকে। মনে হতো ভয়ানক দানবের উপস্থিতি যেন তিনি অনুভব করছেন। জলের স্রোত, ঢেউয়ের পরে ঢেউ আসছে, ঘুরন্ত জলের রেখা-এক অদ্ভুত ভাষায় বন্যাকে যেন জীবন্ত করে তুলেছে।
শিল্পগুরু সাফিউদ্দিন আহমেদের ফটোগ্রাফির প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল।“বাবার ফটোগ্রাফির প্রতি অবশ্যই একটা দরদ ছিল। তিনি পঞ্চাশের দশকে ইউরোপে অবস্থানকালে বিভিন্ন লেন্স এবং রঙিন ফিল্টার সহ একটি জার্মান কনটফ্লেক্স এসএলআর ক্যামেরা কিনেছিলেন । যে ব্যক্তি সর্বদা সরল জীবনযাপন করেন, এটি কেনা বেশ ব্যয়বহুল ব্য্যপার তবে তিনি এটি কিনেছিলেন । অল্প বয়স থেকেই, নাজির অন্ধকার ঘরে ( dark room ) তাহার বাবা শিল্পগুরুকে ছবি ডেভেলাপ করতে দেখেছেন । যখন এই ফ্রেমগুলি থেকে রাসায়নিক দ্রব্যে ডুবানো ছবিগুলি উপস্থিত হত তখন আমি অবাক হতাম “ …
আহমেদ নাজির – সাফিউদ্দিন আহমেদের পুত্র।
বন্যার এর ধ্বংসের ছবি ও সর্বগ্রাসী রূপ করোটির ভেতর বহন করে সফিউদ্দিন বিদেশে যান তাম্রতক্ষণে সর্বাধুনিক করণকৌশল শিক্ষা গ্রহণ করবার জন্য। লন্ডনে ছাপচিত্রের শিক্ষকের কাছ থেকে পেয়েছিলেন উদার স্নেহ।শিক্ষক তার কাজের মধ্যে দেখেছিলেন আগ্রহ সংসারের সুখ টেকনিকের সমন্বিত প্রয়াস। সেজন্য মন প্রাণ দিয়ে দীক্ষিত করেছিলেন ছাত্র সফিউদ্দীন আহমেদকে। শিক্ষার শেষের দিকে তিনি যখন নিজস্ব মৌলিক কাজ শুরু করেন তখন ধমনীর ভেতর সঞ্চিত বন্যার সেই স্মৃতি যেন ফিরে আসে এক পরিশীলিত সৌন্দর্য ও অর্থবহ বিমুর্ত রূপ নিয়ে। সত্যিকার অর্থে বিমুর্ত নয়।বন্যার আসল চেহারা তার ভয়াল রূপ যেন তার মাঝে ফুটে ওঠে।
বন্যাকে মূল থিম করে যখন তিনি অনেকগুলো তাম্রতক্ষণে কাজ করেন। তামার প্লেটে তার কুশলী হাতের স্ট্রোকে আঁকা সেই ঘূর্ণায়মান রেখায় বন্যার রূপ ফুটিয়ে তুলেছিলেন। এই বন্যা সিরিজের তাম্রতক্ষণে তার কুশলী হাতের ছাপ ছিল; আলোছায়ার বিন্যাস ও নব উপলব্ধির সৃষ্টি করেছিল। কাল রেখা এই সিরিজের কাজে ভাস্বর।একই সঙ্গে তিনি সাদা কালোর পাশাপাশি ধূসর টোন গুলোও ফুটিয়ে তোলেন অসাধারণ দক্ষতায়।বন্যা সিরিজের একটি কাজে মোটা কালো রেখা তীব্র আবেগে ফুটে উঠেছে, কখনো কখনো দু’দিক থেকে দু’টি বাঁকা রেখা এসে এক জায়গায় মিলেছে। ঘূর্ণায়মান জলের তীব্রতা অত্যান্ত সুষমভাবে বিন্যস্ত; তবুও তার মধ্যেও যেন জলের সেই শক্তি যেন পরিস্ফুট।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি শিল্পকর্ম: সাঁওতাল রমণী ( সাঁওতাল গার্লস), ১৯৪৬; মেলার পথে (অন ওয়ে টু ফেয়ার), ১৯৪৭; বন্যার কবলে (ইন দি গ্রিপ অফ ফ্লাড),১৯৫৯, মাছ ধরার সময় (ফিশিং টাইম),১৯৬২; ক্রুদ্ধ মৎস্য (অ্যাংরি ফিশ),১৯৬৪; নীল জাল (দি ব্লু নেট),১৯৭৬; মাছ ধরার জাল (ফিশিং নেট),১৯৭৮; ক্রন্দন (দি ক্রাইং),১৯৮০; জলের নিনাদ (সাউন্ড অফ দি ওয়াটার),১৯৮৫; একাত্তরের স্মৃতি (ইন মেমোরি অফ ৭১),১৯৮৮।